Sunday, April 18, 2021

উপকূলীয় অঞ্চলে সয়াবিনের আবাদ কমছে

 


বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা সয়াবিনসমৃদ্ধ জেলা। লক্ষ্মীপুর জেলার প্রায় সব উপজেলায়, বিশেষ করে রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদরের দক্ষিণাংশ এবং রায়পুর উপজেলার চরবংশী, চরআবাবিল ও চরকাছিয়া মিলিয়ে গত রবি মৌসুমে প্রায় ৫৪,৪৫৫ হেক্টর, নোয়াখালী জেলায় ১৬,২৮২ হেক্টর এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ১,৭৮০ হেক্টরসহ সর্বমোট ৭২,৫১৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা এবং খুলনায় সয়াবিনের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট, রংপুর, পাবনা, ঈশ্বরদী ও শাহজাদপুরে রবি-খরিপ মৌসুমে (গ্রীষ্মকালে) সয়াবিন আবাদ বিগত ৪-৫ বছর আগে শুরু হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার শস্য পরিক্রমায় রবি ফসল হিসেবে সয়াবিন একক ও অনন্য সাধারণ ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সয়াবিন চাষিদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সয়াবিন চাষে ঝুঁকি ও খরচ বাদামের তুলনায় অনেক কম, লাভ অনেক বেশি। সয়াবিন উত্তোলনের পর ঐ জমিতে আউশ/আমন ধানের ফলন খুব ভালো হয়। কারণ সয়াবিন একটি উত্তম বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী লিগুম ফসল হিসেবে মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি আবাদ মৌসুমে সয়াবিন মাটিতে হেক্টর প্রতি ২৫০-২৭৭ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে, যা ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের শতকরা প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ। এ ছাড়া সয়াবিনের পাতাসহ অন্যান্য দৈহিক অংশ এবং শিকড় অল্প সময়ের মধ্যে পচে-গলে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অনেক উন্নত হয়। মাটিতে ক্ষুদ্র অণুজীবের কার্যাবলি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মাটি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এভাবে মাটি পরবর্তী ফসলে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ নিশ্চিত করে। পোলট্রি শিল্প বিকশিত হওয়ার কারণে সয়াবিনের দেশীয় চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ২৭-২৯ লক্ষ টন অথচ সয়াবিন সমৃদ্ধ বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে মাত্র ১-১.৫ লক্ষ টন, তার চেয়ে কম বা বেশি সয়াবিন উৎপাদিত হয়। সকল তৈলবীজ ফসলের মধ্যে সয়াবিন অত্যন্ত সংবেদনশীল তৈলবীজ। সয়াবিনে ৪০-৪৫ ভাগ প্রোটিন বিদ্যমান যা অন্যান্য তৈলবীজ ফসলে মাত্র ২০-২২ ভাগ। এই উচ্চ মাত্রার প্রোটিন থাকার কারণে যখনই সয়াবিন বীজ উন্মুক্ত পরিবেশে আনা হয় তখনই ঐুমৎড়ংপড়ঢ়রপ ঘধঃঁৎব বাতাস থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করে। ঐ অবস্থায় মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকলে সয়াবিন বীজ কম অঙ্কুরিত হয়। জলবায়ু সংকটে সয়াবিন চাষ অনেকটা হুমকির মুখে। পূর্বেই বলা হয়েছে, সয়াবিন অত্যন্ত সংবেদনশীল বীজ। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এ দুটি উপাদান সয়াবিন বীজের অঙ্কুরোদ্গমের নিয়ামক শক্তি। কাজেই চাষিদের সয়াবিন বীজ রোপণের ক্ষেত্রে এ দুটি উপাদানের বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত, মাটির তাপমাত্রা ৯০ সেলসিয়াস-এর নিচে থাকলে সয়াবিন বীজ যতই সজীব থাকুক না তা কম অঙ্কুরিত হয় (সগবি, বিএআরআই, নোয়াখালী)।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সয়াবিনের আবাদ এলাকা বিগত ২০১৩ সাল শুরু করে (২০১৬ সাল ব্যতীত) প্রতি বছর কোনো না কোনোভাবেই ব্যাহত হচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন বার ফ্লাশ ফ্লাডের বা হঠাৎ জ্বলোচ্ছ্বাসের কারণে বৃহত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে খরিপ মৌসুমে আবাদকৃত সয়াবিনের প্রায় ৬০ % আবাদ এলাকা জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। এতে সয়াবিন চাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খরিপ মৌসুমে আবাদকৃত বীজ রবি মৌসুমে বীজ হিসেবে ব্যবহূত হয়। ফলে বাজারে বীজ সংকট দেখা দেয়। এক কেজি সয়াবিন বীজের বাজার মূল্য ১৫০-২৮০ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে। সয়াবিন চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিএডিসির বীজের সরবরাহ বাজারে মোটামুটি সন্তোষজনক থাকলেও কৃষক খরিপের বীজ ব্যবহারে আগ্রহী। কারণ খরিপ মৌসুমে আবাদকৃত বীজের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা প্রায় শতভাগ যা রবি মৌসুমে বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে সরকার কর্তৃক ধানের মূল্য বৃদ্ধি করার কারণে কৃষক ধান চাষের প্রতি ঝুঁকছে। ফলে ২০২০-২০২১ রবি মৌসুমে সয়াবিনের প্রায় ২৫-৩০ ভাগ আবাদ এলাকা বোরো আবাদে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের বাজার মূল্য বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে ফড়িয়াসহ আড়তদারদের সিন্ডিকেট ব্যবস্থার কারণে কৃষক সয়াবিনের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অন্য অর্থকরী ফসল তরমুজ আবাদে ঝুঁকছে। এখানেও দেখা যায়, সয়াবিনের আবাদ জমির প্রায় ২০-২৫ ভাগ তরমুজ চাষে পরিবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রায় ১২,০০০ হাজার হেক্টর সয়াবিন আবাদ এলাকা মেঘনা নদী ভাঙনের ফলে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এভাবে সয়াবিন আবাদ এলাকা ক্রমেই কমে যাচ্ছে বলে কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদরা মতামত পেশ করেছেন। এর থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের কৃষি বিভাগগুলোর আরো তৎপর হওয়া একান্ত প্রয়োজন। সাথে সাথে উচ্চফলনশীল জাতের চাষাবাদ বাড়ানো, জীবাণু সার ব্যবহার, সয়াবিন চাষে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বৃহত্তর নোয়াখালী জেলাকে সয়াবিন আবাদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তিকরণ, সয়াবিন আবাদ মৌসুমে ২-৪% সুদে কৃষি লোনের ব্যবস্থাকরণ এবং সয়াবিনের মূল্য বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। সর্বোপরি সয়াবিন আবাদে দুর্যোগকালীন সময়ে সয়াবিন চাষিদের সরকারিভাবে ভর্তুকি তহবিল হতে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা।

লেখক :ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সগবি, বিএআরআই, নোয়াখালী

মোবাইল-০১৮২৭৮৬৫৮৬০


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: